॥ এম শাহনাজ পারভীন চৌধুরী ॥
মানব সভ্যতায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত যে কোনো দেশের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যোগাযোগ ব্যবস্থাপনাই হয়ে উঠে সে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল উন্নতির জন্যই পুরো বিশ্বসহ ইউরোপে যুক্তরাজ্যের সমৃদ্ধি স্বর্ণশিখরে। বিশ্বে যুক্তরাজ্যের সমৃদ্ধির উত্থান একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুগোপযোগী ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা বিশ্বের কাছে আজ সুপরিচিত। ইচ্ছে করলে নিমিষেই চলে যাওয়া যায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সবকিছু অর্থহীন করে দিয়ে পুরো বিশ্বকে থমকে দিয়েছে করোনা নামক মহামারি। বাদ যায়নি যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙ্গালীরা। করোনায় স্থানীয় নাগরিকের মতো প্রবাসী বাঙ্গালীরাও আছেন আতঙ্কে। সবকিছু থমকে গেলেও ধীরে ধীরে আবারো পুরনো রূপে ফেরার চেষ্টা করছে যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপোর্ট সিষ্টেম। করোনাকালীন সময়ে ব্যস্ততম ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমকেও স্থগিত করা হয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে সুদূর ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানো প্রবাসীসহ নাগরিকদের জীবন চালানোর একমাত্র পাথেয় কর্মস্থল- কর্মজীবন ৷ অদৃশ্য ছায়াশত্রু করোনা ঝুঁকিকে আত্মস্থ করে কর্মস্থলকে নিরাপদ করে ধীরে ধীরে সবকিছু সামলে নেয়া যায়৷ কিন্তু কর্মস্থলে নিরাপদে পৌঁছানোও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ কর্মস্থল আর বাসস্থান যদি কম দূরত্বের না হয়, তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছানোর বিষয়টাও ভাল করেই মাথায় রাখতে হয়৷ আর এ বিষয়টা বর্তমানে একটা পাজলের থেকেও কিছু কম নয়৷ যুক্তরাজ্য সরকার যতই পাবলিক পরিবহন এড়াতে বলছে- মানুষ ততই স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। ঝুঁকি নিয়ে নিরুপায় হয়েই পাবলিক ট্রান্সপোর্টের শরণাপন্ন হচ্ছে মানুষ। কারণ এটাই হয়তো একটা উপায়৷
করোনা ঝুঁকিকে সঙ্গী করে নিরাপদ থাকার জন্য নিয়ম কানুন প্রণয়ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু কথা হলো- জীবনকে আমরা যত সহজ করার চেষ্টাই করি না কেন, ‘জীবন’ যেন এখন ঘরের দরজা থেকেই আমাদের আতঙ্কিত করে ফেলছে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকা’তে শুধুই করোনাবৃত্তান্ত। মনের ভিতর থেকে চিন্তার ছায়া মুছে ফেলতে চাইলেও কোথাও না কোথাও তার নিরব বিচরণ রয়ে যায়৷
লন্ডন ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে, একই সময়ে একটি বাসে কতজন উঠতে পারবে সেই বিষয়ে একটি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এর ফলে গণপরিবহনে সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি হয়তো মেনে চলা সম্ভব হবে যাত্রীদের, এমনটাই আশা করা যায়৷ এই ক্ষেত্রে ডাবল ডেকার বাসগুলো নিতে পারবে ২০ জন যাত্রী এবং সিঙ্গেলগুলো আকার অনুযায়ী নিতে পারবে ৬-১০ জন যাত্রী৷ আর যে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্টে মাস্ক পড়াটাকেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সচেতনতা যখন একটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এখানকার নাগরিকরা তাদের জীবনে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাসহ বিভিন্ন বিধি-নিষেধ মেনে চলতে খুব সহজেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বলা যায়- লন্ডন ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ হয়তো সুন্দর একটা পদক্ষেপ নিয়েছে।
করোনাভয়ে বিভিন্ন অফিস তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে ঘরে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে কর্মীদের। এই প্রেক্ষাপটে আসলেই তাঁরা সৌভাগ্যবান। অন্ততপক্ষে মনের ভিতরে সৃষ্টি হওয়া ভয়ের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। আর জীবিকা নির্বাহের জন্য যেহেতু কাজে যেতেই হবে, তখন মনে সাহস সঞ্চয় করতেই হয় ভয়কে জয় করার জন্য। হ্যা, ভয়কে তো জয় করতেই হবে। আর এই সত্যটুকু এখন প্রবাসীদের চেয়ে বাংলাদেশের জনগণের জন্য বেশি প্রযোজ্য। কারন গরীব দেশ হিসেবে সরকার চাইলেও পারবেন না যাতায়াত ব্যবস্থার এত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
লন্ডন ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ বরাবরই অনুর্ধ্ব ১৮ বৎসর পর্যন্ত ফ্রী পাস দিয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এটা একটি অজানা সময়ের জন্য। যদিও এখন পর্যন্ত চালু করা হয়নি। পরবর্তী স্কুল ছুটির সময় থেকে কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়। লন্ডনে শুধু ৩০% ছাত্র ফ্রি পাস পেয়ে থাকে তাই কর্তৃপক্ষ যদিও দেখতে পাচ্ছেন এই উপায়ে রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা যাবে, আবার উদ্বিগ্ন হচ্ছেন ছাত্রদের অতিরিক্ত খরচের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিতি না বেড়ে যায়, সেই আশংকায়।
একটা বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে এই দেশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যেভাবে বিচার বিশ্লেষণ এবং তথ্য উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করেন, সর্বোপরি তাদের আত্মনিয়োগ- সত্যিই তা প্রশংসনীয়। যদিও ফ্রি পাস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাও এক বৃহত্তর স্বার্থে। ছাত্রদের জন্য অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হবে বলেও আস্থা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই উপায়ে রোগ সংক্রমণ কমানোর উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তবে যুক্তরাজ্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে রোগ সংক্রমণ কমাতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে। প্রতিদিনের মৃতের হার এখন অনেকটাই কমে এসেছে, যা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে সহায়ক। সরকারি গবেষণায় এসেছে, লকডাউন কার্যকর হওয়ার ফলে সংক্রমণের হার ৮১% কম করা সম্ভব হয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার অবদানও কোনও অংশে কম নয়।
সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হলেও প্রিয় মাতৃভূমি লাল-সবুজের ঘনবসতির বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ভয়ঙ্কর এক চ্যালেঞ্জের নাম করোনা। সরকারের সাথে সাথে দেশের জনগণ যদি নিজেদের সচেতনতা বাড়িয়ে তুলতে পারে- সেটাই হবে সরকারের জন্য দারুন স্বস্তিকর। যুক্তরাজ্যের মতো দেশ কিংবা উন্নত দেশের নাগরিকরা যতটুকু সচেতন, ততটুকুই অসচেতন উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশের বাসিন্দারা।
করোনা সংক্রমণ শূন্যের কোঠায় নামুক, করোনা আতঙ্ক থেকে মুক্ত হোক বিশ্ব, জয় হোক মানবসভ্যতার। সেই চেনা যানজট কিংবা কাজের ব্যস্ততা অথবা জীবনের জয়গান আবার পুরনো রূপে ফিরে আসুক- সেখানে অন্তত মৃত্যুর হাতছানি নেই, নেই প্রিয়জন হারানোর আশঙ্কা। জীবনের জয়গানে এগিয়ে যাক এই অপূর্ব সুন্দর পৃথিবী।