অপেক্ষা । ইখফা রহমান মিথিলা
শিক্ষার্থী,ইংরেজী বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কিরে প্রান্ত,আর কত ঘুমাবি?
মায়ের ডাকে তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে ওঠে প্রান্ত ।ঘড়িতে তখন ১০টা বেজে ১৫ মিনিট।আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসে সে।আকাশ মেঘলা ,মৃদু বাতাসে উড়ছে পর্দা ।চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সে ।বাতাসটা ঠান্ডা।নিশ্চয় বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও ,এদিকেও হয়তো হবে।চা শেষ করে তাড়াতাড়ি গোসল সারে প্রান্ত ।
সবুজ রঙের নতুন একটা পাঞ্জাবি বের করে চট করে তৈরি হয়ে নেয়।দেখতে নতুন হলেও ৪ বছরের পুরোনো এটা।চার বছর আগে কেউ একজন তাকে দিয়েছিলো এটা। বছরে একদিনই পান্জাবিটা পড়ে সে।দ্রুত পায়ে হেঁটে সে রাস্তার ওপারের ফুলের দোকানটায় যায় ।
:মামা ভালো দেইখা ৮টা লাল গোলাপ দেন
:এইগুলা দিই মামা?
:আরে মামা এইগুলা না।ওই যে আধা ফোটা যে ওগুলা দেন।
গোলাপ গুলো নিয়ে একটা অটো ডেকে ওঠে পড়ে প্রান্ত
:হাইওয়ের কাছে যান তো মামা
কিছুদূর যাওয়ার পরেই জ্যামে পড়ে প্রান্ত ।অস্থির হয়ে ওঠে সে।কতক্ষণ লাগে কে জানে।আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণ পরেই।দুই যুবক যুবতীর হাসিঠাট্টার আওয়াজ শুনে পেছনে তাকিয়ে বাইকে বসা দুই কপোত কপোতীকে দেখতে পায়।তাদের দেখে তার মন চলে যায় চার বছর আগের দিনগুলোতে।
৭ বছর আগে এমনি কোনো মেঘলা দিনে মেঘলার সাথে প্রথম দেখা হয় প্রান্তর ।বন্ধু ছিলো মেঘলা।কিন্তু কি করে যেন একদিন হাসি ঠাট্টার ছলেই ওর সাথে জড়িয়ে যায় প্রান্ত ।বন্ধুত্ব পরিণত হয় প্রেমে।রিলেশন হওয়ার ১মাস পর মেঘলাকে দেখে সে ।এখনো মনে আছে প্রান্তর ।সেই থেকে শুরু ।কত যে ঘুরেছে দুইজনে।মেঘলার যে কত আজব আজব শখ ছিলো।বৃষ্টিতে টঙের দোকানে চা খাওয়া, চাঁদ দেখা,শাড়ি পরে ভার্সিটির রাস্তায় প্রান্তর হাত ধরে হাঁটা।প্রান্ত বরাবরই একটু কাঠখোট্টা টাইপের ।মেঘলার এসব শখ ওর ন্যাকামো লাগলেও সে এসব করতো শুধু মেঘলার সাথে থাকার জন্য ।মেয়েটার সাথে থাকলে ওর মধ্যে যেন একটা খুশির ভূত ভর করতো,সব অন্যরকম লাগতো,অন্যরকম ভালোলাগা ,অন্যরকম একটা খুশি লাগতো চারপাশে ।
:মামা,নামেন
অটোওয়ালার ডাকে বাস্তবতায় আসে প্রান্ত ।ভাড়া চুকিয়ে নেমে পড়ে সে।।রাস্তা পার হয়ে হাইওয়ের ওপারের জঙ্গলের সামনের বকুল গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়ায় ।আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে ।
সেইদিনও ও বৃষ্টি ছিলো।খুব অভিমানী ছিলো মেয়েটা ।প্রান্ত বরাবরই একটু বদমেজাজি ছিলো ।কিন্তু তার একটা ধমকও সহ্য হতো না মেয়েটার।সারাদিন কান্না করতো।মেঘলা প্রায়ই আবদার করতো বৃষ্টির দিনে ওর জন্য গোলাপ নিয়ে দেখা করতে।কিন্তু প্রান্তর এসব ন্যাকামো লাগতো তাই ওর আজব আবদার গুলোকে তেমন পাত্তা দিতো না।
সেই দিনের পর থেকে প্রান্ত প্রত্যেক বছরই গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করে মেঘলার জন্য ।কিন্তু মেঘলা আর কখনো আসবে না ওর অপেক্ষায় সাড়া দিতে।
চারবছর আগে সেদিন রাগে খুব উল্টা পাল্টা বলে ফেলে সে মেঘলাকে ।খুব কষ্ট পায় মেয়েটা। একটা বার দেখা করতে চায় সে প্রান্তর সাথে ।এই বকুল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বারবার ফোন দেয় প্রান্তকে ।রাগের চোটে প্রান্ত আসেনি ফোন ও ধরেনি।আর সেই রাগটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ওর জীবনে।রাগ করে সে ওইদিন সে ফোন বন্ধ করে রাখে ।।ওইদিনের পর কয়েকদিন ধরে মেঘলার কোনো কল মেসেজ না পেয়ে সে ও রাগে আর কল দেয় নি।সাতদিন পর মনে খটকা লাগলে প্রান্ত মেঘলার বন্ধুকে ফোন দিয়ে যা জানলো তা তার জীবনের সব আনন্দ কেড়ে নেয় ।ওইদিন প্রান্ত রেগে ফোন বন্ধ করে রাখার পর সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানে অপেক্ষা করে মেঘলা ।সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে একদল দুর্বৃত্ত মেঘলাকে খুব বাজেভাবে ধর্ষণ করে এই বকুল গাছের নিচে ফেলে যায় মৃত অবস্থায়।
এরপর থেকে প্রতিবছর আজকের এই দিনে প্রান্ত এই বকুল গাছের নিচে আসে,গোলাপ নিয়ে ।
আরো জোরে বৃষ্টি নামছে।মেঘলার অভিমান গুলো যেন ঝরছে।চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে প্রান্ত।ভিজছে ওর অভিমানী ধারায়।অপেক্ষায় আছে শুধু আর একটাবার সেই ন্যাকা গলার আবদার শোনার,”এই চলোনা টঙে চা খেতে যাই”।
Touching
❤❤❤